শিকারি ও খাদ্য সংগ্রাহক আদিম মানুষের সংস্কৃতি
প্রাগৈতিহাসিক যুগে দীর্ঘকাল ধরে শিকারি আদিম মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এই সম্পর্ক থেকে শিকারি মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতির জন্ম হয়। মানুষের কাজ করার দুটি হাত এবং উন্নত মস্তিষ্ক তার সাংস্কৃতিক বিকাশে সর্বাধিক সহায়তা করেছিল। শিকারি ও খাদ্যসংগ্রাহক আদিম মানুষের সংস্কৃতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি আলোচনা করা হলো।
১. মাতৃতান্ত্রিক সমাজ জীবনঃ
আদিম যুগের শিকারি ও খাদ্যসংগ্রাহক মানুষ জীবনের নিরাপত্তা ও খাদ্যসংগ্রহের তাগিদে দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করত এবং শিকারে বের হত। এই দলবদ্ধতা থেকে আদিম শিকারি মানুষের মধ্যে ক্রমে সামাজিক সম্পর্কের বিকাশ ঘটতে শুরু করে। চিনের ঝাউ-কাউ-তিয়েন পাহাড়ের গুহায় একই সঙ্গে পুরুষ, স্ত্রী ও শিশুর দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। এটি শিকারি মানুষের পারিবারিক জীবনের প্রমান দেয়। আধুনিক গবেষকগণ মনে করেন যে, শিকারী মানুষের পরিবার ছিল মাতৃতান্ত্রিক।
২. হাতিয়ারের ব্যবহারঃ
আদিম শিকারি মানুষ খাদ্যের সংস্থান ও জীবনের নিরাপত্তার প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার বা বস্তগত উপকরনের ব্যবহার শুরু করেছিল ꫰ তাদের ব্যবহার্য সামগ্রীর মধ্যে অন্যতম ছিল পাথরের হাত - কুঠির ꫰ এ ছাড়া পাথরের ছুরি ,শাবল ,বড়শি , বর্শা , হারপুন প্রভৃতিও তারা ব্যবহার করত ꫰ শিকারি যুগের মানুষ পশুর চামড়া সেলাই করে পোশাক , চামড়ার ঝুড়ি ও পাত্র তৈরি করত ꫰ আদিম মানুষের শিকারি পর্যায়ের শেষদিকে তিরধনুকের আবিষ্কার হয়েছিল ꫰ তারা কাঠ বা পাথর ছিদ্র করার যন্ত্রও তৈরি করেছিল ꫰
৩. বাসগৃহ নির্মানঃ
শিকারি মানুষেরা প্রথমদিকে গুহায় বসবাস করলেও তা তাদের চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত ছিল না ꫰ কারন তারা পৃথিবীর যেসব ভূখন্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্রই পাহাড়ের গুহাছিল না ꫰ তা ছাড়া তারা আগুন আবিস্কারের পূর্বে অন্যান্য হিংস্র পশুদের তাড়িয়ে গুহা দখল করতেও সক্ষম হয়নি ꫰এর ফলে শিকারি মানুষ বসবাসের প্রযোজনে ঘর তৈরি করতে শিখেছিল ꫰ তারা ডালপালা, জন্তুজানোয়ারের হাড় , লতাপাতা , মাটি প্রভৃতি দিয়ে ঘর তৈরি করে তার উপর চামড়া আচ্ছাদন দিত ꫰ চেকোশ্লোভাকিয়ার আদিম শিকারি মানুষের এরুপ আস্তানার নিদর্শন মিলেছে ꫰
৪. আগুনের ব্যবহারঃ
আগুন আবিষ্কার ছিল এ যুগের অন্যতম ঘটনা। সম্ভবত আগ্নেয়গিরি বা দাবানলের আগুন থেকে আদিম মানুষ সর্বপ্রথম আগুনের ব্যবহার শিখেছিল। অবশ্য তখন মানুষ আগুনের ব্যবহার শিখলেও তারা নিজের হাতে আগুন জ্বালাতে শিখেছিল আরও অনেক পরে। যাই হোক, আগুন ব্যবহার করে শিকারি মানুষ শীতের প্রোকোপ থেকে রক্ষা পেয়েছিল এবং আগুন দেখিয়ে হিংস্র পশুদের তাড়িয়ে নিজেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছিল। আগে শিকারি মানুষ কাঁচা মাংস খেত। আগুনের ব্যবহার শিখে তারা মাংস পুড়িয়ে খেতে শুরু করে। এভাবেই ধীরে ধীরে মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত হতে শুরু করে।
৫. মৃৎপাত্রের ব্যবহারঃ
আগুনের ব্যবহার শেখার পর সেই আগুনে রান্না করা বা কিছু গরম করার প্রয়োজনেই মৃৎপাত্রের আবিষ্কার হয়। পরবর্তীকালে রান্নাবান্নার কাজ-সহ বহু ধরনের কাজেই মৃৎপাত্রের ব্যবহার শুরু হয়। কুমোরের চাকা আবিষ্কৃত হলে মৃৎশিল্পেরও অভাবনীয় উন্নতি ঘটে।
৬. জলযানের ব্যবহারঃ
প্রাচীন শিকারি মানুষ জলপথে যাতায়াত ও পন্য পরিবহনের জন্য ডোঙ্গা জাতীয় নৌকা তৈরি করতে শিখেছিল । আজ থেকে ৮০০০ বছরেরও বেশি আগের এরকম একটি নৌকা হল্যান্ডে আবিষ্কৃত হয়েছে । গাছের গুঁড়ি খোদাই করে এটি তৈরি হয়েছিল । কাঠের নৌকা ছাড়াও শিকারি মানুষ চারড়ার নৌকা ও ভেলা তৈরি করত ।
৭.পশুপালনঃ
আদিম শিকারি মানুষের প্রথম পোষ মানানো প্রানী হল শিকারি কুকুর । অবশ্য মানুষ নিজের চেষ্টায় কুকুরকে পোষ মানাতে সক্ষম হয়েছিল নাকি কুকুরই স্বেচ্ছায় মানুষের পোষ মেনেছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে । যাই হোক কুকুরের তীব্র ঘ্রানশক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিকারি মানুষ বহু দূরের শিকারের সন্ধান পেত পোষ মানানো কুকুর পশুর পালকে তাড়া করে শিকারের কাজে মানুষকে সহায়তা করত । মানুষ বরফের উপর দিয়ে শ্লেজ গাড়ি টানার কাজেও কুকুরকে কাজে লাগাত। কুকুর ছাড়াও শিকারি মানুষ গোরু, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি প্রানীকে পোষ মানিয়েছিল ।
৮. পোশাকের প্রচলনঃ
পন্ডিতগন মনে করেন যে, সর্বপ্রথম শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আদিম শিকারি মানুষ পশুর চামড়া গায়ে জড়াতে শুরু করে । চামড়ার এই আবরন ক্রমে নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে আদিম মানুষের পোশাকে পরিনত হয় ।পোশকের প্রচলনের ফলে মানুষ বিভিন্ন আবহাওয়া বসবাস করার উপযোগী হয়ে ওঠে ।
৯.চিএকলাঃ
শিকারি যুগের গুহাবাসী মানুষ তাদের গুহার অভ্যন্তরে তাদের শিকারি জীবনের নানা চিত্র অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলত । সৌন্দর্যবোধ থেকে ণয়, মূলত শিকারের প্রয়োজনেই এই চিত্রকলার উদ্ভব ঘটেছিল । বিভিন্ন পশুর প্রতিকৃতি , শিকারের দৃশ্য ,তিরবিদ্ধ আহত পশুর সামনে নৃত্যরত মানুষের দল প্রভৃতি ছিল সেসব চিত্রকলার প্রধান বিষয়বস্তু। ইউরোপে স্পেন ও ফ্রান্স-সহ অন্যান্য কয়েকটি স্থানে ও আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে এরুপ গুহাচিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে ।
১০. ধর্মবিশ্বাসঃ
শিকারি মানুষের গুহাচিত্রগুলি থেকে তাদের ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়। গুহার যে অংশে মানুষ বসবাস করত বা দিনের আলো প্রবেশ করত সেই অংশে ছবি না একে গুহার অনেক গভীরে লোকচক্ষুর অন্তরালে ছবিগুলি আঁকা হত । পন্ডিতগন মনে করেন যে , শিকারি মানুষের দল সম্ভবত এক ধরনের জাদুবিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাস থেকেই গুহার অত্যন্ত গভীরে তাদের চিত্রগুলি আঁকত । মনে করা হয় যে , শিকারে মাওয়ার আগে তারা কোনো শক্তির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে ভালো শিকার পাওয়া ও শিকার করে নিরাপদে গৃহে ফেরার আশাতেই এসব চিত্রগুলি এঁকেছিল ।