জাতীয়তাবাদের মূল্যবিচারঃ
জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনীতিক আদর্শ। এই আদর্শের সমর্থনে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করা হয়।
একটি মহান আদর্শঃ
জাতির জীবনে জাতীয়তাবাদ একটি মহান আদর্শ। এ হল এক গভীর অনুপ্রেরণা। জাতীয়তাবাদ জাতিকে ঐক্যবোধে একাত্ম করে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এই আদর্শ দেশের ও দশের স্বার্থে আত্মত্যাগে ব্যক্তিকে অনুপ্রাণিত করে। এইভাবে জাতির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের আবহাওয়া সৃষ্টি হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দীপকঃ
মুক্তিকামী দেশের পক্ষে জাতীয়তাবাদ আশীর্বাদস্বরূপ। জাতীয়তাবাদের দ্বারা গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরাধীন ও দুর্বল জাতি মরণপণ স্বাধীনতা-সংগ্রামে সামিল হয় এবং স্বাধীন ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। অনেক বিচ্ছিন্ন জাতীয় জনসমাজ জাতীয়তাবাদের মহান আদর্শের প্রভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং স্বৈরাচারী বিদেশী শাসনের শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রামে সামিল হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের ইতিহাসে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ পরাধীন মানবগোষ্ঠীর বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের এবং জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিকতা অর্জনের উজ্জ্বল কাহিনী আছে।
মানব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেঃ
জাতীয়তাবাদের জনক হিসাবে ইতালীর দার্শনিক ম্যাৎসিনি-র কথা বলা হয়। তাঁর মতানুসারে বিভিন্ন গুন ও প্রতিভার বিকাশ সাধনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করে । বিশ্বের প্রত্যেক জাতির একেবারে নিজস্ব কিছু গুন বা বৈশিষ্ট্য থাকে । জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে এইসব গুনাবলীর বিকাশ ঘটে । প্রত্যেক মানবগোষ্ঠী জাতীয় গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্যের যথাযথ বিকাশের জন্য জাতীয় স্বাধীনতা ও আত্মবিকাশের অধিকারের স্বীকৃত অপরিহার্য । পৃথিবীর প্রতিটি জাতির স্বকীয়তার স্বাধীন বিকাশ সুনিশ্চিত হলে মানবসভ্যতা সমৃদ্ধশালী ও বৈচিত্রপূর্ণ হয়ে উঠবে।
সহযোগীতার আবহাওয়া গড়ে তোলেঃ
জাতীয়তাবাদ জাতিসমূহের মধ্যে সংঘাত- সংঘর্ষের আশংকা দূর করে এবং সহযোগিতা ও সম্প্রীতির সম্পর্ক সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধু জাতীসমূহের মধ্যে বিবাদ - বিসংবাদের প্রবনতা থাকে না , তাঁর পরিবর্তে সৌভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যবোধ জাগ্রত হয়। এইসব জাতি নিজের উন্নতি ত্বরান্বিত করে এবং অপরের উন্নতিতে সাহায্য করে ।
শাসক ও শাসিতের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কঃ
জাতীয়তাবাদ দেশের শাসনব্যবস্থাকে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল করে । জাতীয়তাবাদের কারনে দেশের মধ্যে শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক সহজ ও স্বাভাবিক হয় । আইনের নির্দেশ ও আইন মান্য করার মধ্যে কোন রকম অস্বস্তিকর ফাঁক থাকে না । তাঁর ফলে সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও ব্যক্তি- স্বাধীনতার মধ্যে সহজ সম্পর্ক স্থাপিত হয় । দেশবাসীকে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের সামিল করার ক্ষেএে জাতীয়তাবাদের অবদান অনস্বীকার্য। জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ছাড়া কোন সরকারই জনসাধারনের কাছ থেকে আনুগত্য আদায় করতে পারে না । স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ও এ ক্ষেএে অসহায় বোধ করে , তা ছাড়া রাষ্টের ভিতরে শান্তি - শৃঙ্খলা সংরক্ষনের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ চেতনা সহায়ক ভূমিকা পালন করে ।
গনতন্ত্রের অনুকূলঃ
জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সুস্থ গণতান্ত্রিক অধিকার ও চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ সহায়ক ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। জাতীয়তাবোধ একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে দেশবাসীর মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এই কারনে ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে একটি গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। ইতিহাসে এরকম নজিরের অভাব নেই।
আন্তর্জাতিকতার পরিপূরকঃ
জাতীয়তাবোধ জাতিকে নীজের জাতীয় চরিত্র ও স্বকীয়তা সংরক্ষণে যেমন উদ্দীপ্ত করে তেমনি অপর জাতির সঙ্গে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে অনুপ্রাণিত করে। জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির পথকে প্রশস্ত করে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদ সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হয়। তার ফলে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
* সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের অশুভ আক্রমণ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে জাতীয়তাবাদী আদর্শ। জাতীয়তাবাদী আদর্শই এশিয়া ও আফ্রিকায় ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারকে রোধ করেছে এবং বহুলাংশে অপসারিত করেছে।